বাংলাদেশের অর্থনীতিতে খনিজ সম্পদের গুরুত্ব। খনিজ সম্পদ অধাতব ও ধাতব কোনগুলো।
প্রিয় পাঠক, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে খনিজ সম্পদের গুরুত্ব কতটুকু এবং খনিজ সম্পদ অধাতব এবংধাতব কোনগুলো আপনি যদি না জেনে থাকেন তাহলে আজকের এই পোস্টটি আপনার জন্য আর আপনি যদি জেনে থাকেন তাহলে আজকের এই পোস্টটি আপনার জন্য নয় ।
সূচিপত্রঃ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে খনিজ সম্পদের গুরুত্ব। খনিজ সম্পদ অধাতব ও ধাতব কোনগুলো।
- কৃষি উন্নয়ন
- শিল্প উন্নয়ন
- বিদ্যুৎ উৎপাদন
- গৃহস্থালির জ্বালানি
- সরকারি আয়ের উৎস
- পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা
- রপ্তানি আয় বৃদ্ধি
- আমদানি ব্যয় হ্রাস
- অর্থনৈতিক উন্নয়ন
- মুদ্রার অপচয় হ্রাস
- অধাতব খনিজ
- ধাতব খনিজ
কৃষি উন্নয়ন কৃষি উন্নয়ন
বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নে খনিজ সম্পদ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। প্রাকৃতিক গ্যাস দ্বারা সার ও কীটনাশক তৈরি করা হয় ।আবার বিভিন্ন ধরনের কৃষি যন্ত্রপাতিও (কুদাল ,দা ,কাস্তে) তৈরি করা হয় খনিজ সম্পদের মাধ্যমে।
শিল্প উন্নয়ন
বাংলাদেশের শিল্প উন্নয়ন ও খনিজ সম্পদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
খনিজ পদার্থ শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহৃত হয় ।যেমন -প্রাকৃতিক গ্যাস
শুধু শিল্পের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয় না বরং রাসায়নিক শিল্পের (রং , গ্রিজ
)কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় ।খনিজ সম্পদের উপর ভিত্তি করে ছোট -বড় অনেক কল
কারখানা গড়ে উঠেছে শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত
হয়। চুনাপাথর ,সিলিকা বালি ইত্যাদি শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে ব্যাপকভাবে
ব্যবহৃত হয়।
বিদ্যুৎ উৎপাদন
বাংলাদেশের তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে প্রাকৃতিক গ্যাস ,খনিজ তেল ও কয়লা দ্বারা
বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে ।যা আমাদের শিল্প উন্নয়ন ও দৈনন্দিন জীবনে বিরাট
ভূমিকা রাখছে ।আমাদের দেশে উৎপাদিত বিদ্যুতের ৯০.৬৬% গ্যাস ভিত্তিক (সূত্র
পেট্রোবাংলা)।
গৃহস্থালির জ্বালানি
বাংলাদেশের প্রাপ্ত প্রাকৃতিক গ্যাস শুধু শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়
না। এগুলো গৃহস্থালিতে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয় ।যেমন -ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ
শহরে।
সরকারি আয়ের উৎস
বিভিন্ন প্রকার খনিজ সম্পদ বিশেষ করে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করে সরকার প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে অর্থ আয় করে থাকে। যা বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় করা হয়।
পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা
বাংলাদেশের প্রাপ্ত নুড়িপাথর ও কঠিন শিলা রেল লাইন , রাস্তাঘাট
,পুল ও কালভার্ট ইত্যাদি নির্মাণ ও মেরামতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে ।আবার পরিবহন
তৈরিতে বিভিন্ন প্রকার খনিজ সম্পদ ব্যবহৃত হয় ।তাই পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার
উন্নয়নে খনিজ সম্পদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
রপ্তানি আয় বৃদ্ধি
খনিজ সম্পদ ব্যবহারের ফলে কৃষি উন্নয়ন ও শিল্প উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে ।ফলে কৃষি ও শিল্প উভয় ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে ।উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে পণ্যের বাকি অংশ দেশের বাইরে রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে। ফলে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আমদানি ব্যয় হ্রাস
খনিজ সম্পদ ব্যবহারের ফলে কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে ।ফলে বিদেশ থেকে
পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে না । ফলে আমদানি হ্রাস পাচ্ছে।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন
বাংলাদেশের প্রাপ্ত বিভিন্ন খনিজ সম্পদকে সঠিকভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি
,শিল্প এবং পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের সঠিক অর্থনৈতিক
উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে।
মুদ্রার অপচয় হ্রাস
দেশে খনিজ সম্পদের প্রাচুর্য থাকলে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে খনিজ সম্পদ আমদানির
প্রয়োজন পড়ে না ।ফলে মুদ্রার অপচয় হ্রাস পায়।
অধাতব খনিজ
১।চুনাপাথর
এটি বাংলাদেশের অন্যতম একটি খনিজ ।বাংলাদেশের সিলেট ও বগুড়া অঞ্চলে এর সন্ধান পাওয়া গেছে ।সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার সীমান্ত সংলগ্ন বাগলিবাজার ,লালঘাট এবং টাকেরঘাট নামক স্থানে স্বল্প গভীরতায় ৬ থেকে ৭৬ মিটার চুনাপাথরের ক্ষেত্র রয়েছে।
এর মধ্যে বাগলিবাজারে ১৭ মিলিয়ন ,লালঘাটে ৯.৮ মিলিয়ন টাকেরঘাটে
২.২ মিলিয়ন টন চুনাপাথর মজুদ আছে। বগুড়া অঞ্চলের জয়পুরহাটের জামালগঞ্জে এবং
নওগাঁর পত্নীতলায় অবস্থিত চুনাপাথর ক্ষেত্র অধিক গভীরতায় ৫১৭ থেকে ৫৪৮মিটার
অবস্থিত ।খনি দুইটিতে মজুদের পরিমাণ পায়।২৭০ মিলিয়ন টন এছাড়া নওগাঁর বাদলগাছি
উপজেলায়.২,২৭০ ফুট গভীরতার সন্ধান পাওয়া গেছে ।বাংলাদেশের একমাত্র দ্বীপ সেন্ট
মার্টিনে প্রায় এক মিলিয়ন মেট্রিক টন চুনা পাথর সঞ্চিত রয়েছে।
ব্যবহার
আমাদের দেশে চুনাপাথরের বহুবিধ ব্যবহার রয়েছে ।ঘর নির্মাণে ,সিমেন্ট প্রস্তুতিতে, সিমেন্ট প্রস্তুতিতে ও কাগজ শিল্পে এবং সাবান ও ব্লিচিং পাউডার তৈরিতে চুনাপাথর ব্যবহার করা হয়।
২।কঠিন শিলা
বাংলাদেশের রাজশাহী বগুড়া দিনাজপুর এবং রংপুর অঞ্চলে কঠিন শিলা ক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। দেশে কঠিন শিলার মোট মজুদের পরিমাণ ১৭১ মিলিয়ন টন ,যার মধ্যে উত্তোলনযোগ্য প্রায় ১০১ মিলিয়ন টন।
দিনাজপুর এবং রংপুর অঞ্চলের কঠিন
শিলাক্ষেত্র স্বল্প গভীরতায় অবস্থিত ।তাই এখানকার শিলাক্ষেত্র
বাণিজ্যিক উত্তোলনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে । দিনাজপুরের রানী পুকুরে
প্রায় ৩০ কোটি মেট্রিক টন কঠিন শিলা সঞ্চিত রয়েছে ।মধ্যপাড়ায় ভূপৃষ্ঠের ১২২
থেকে ২২৫মিটার গভীরতা পর্যন্ত পুরু এই স্তরে আনুমানিক ৪০ কোটি মেট্রিক টন কঠিন
শিলা সঞ্চিত রয়েছে।
ব্যবহার
বাংলাদেশে রেলপথ ও রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং সেতু নির্মাণে কঠিন শিলা ব্যবহার করা হয়।
৩। চিনা মাটি
ময়মনসিংহের উত্তর সীমান্ত সংলগ্ন বিজয়পুরে ১৯৫০ এর দশকে শ্বেত মৃত্তিকার সন্ধান
পাওয়া যায়। গারো পাহাড় সন্নিহিত এই শ্বেত মৃত্তিকার স্তর পার্শ্ববর্তী পলল
গঠিত সমভূমি এলাকা থেকে কিছুটা উঁচুতে অবস্থিত ।দুই থেকে সীমিত পরিসরে ৪
মিটার পর্যন্ত পুরুএবংএই স্তরে আনুমানিক ২ লক্ষ মেট্রিক টন শ্বেত মৃত্তিকা
সঞ্চিত রয়েছে ।যেমন -শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি , নওগাঁ জেলার পত্নীতলা
,হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলায় চিনামাটির সন্ধান পাওয়া গেছে।
ব্যবহার
বাসনপত্র ,সৌখিন দ্রব্যাদি , বৈদ্যুতিক ইনসুলেটর সেনিটারি সরঞ্জাম কাগজ ও বিভিন্ন
প্রকার রাসায়নিক শিল্পে চিনামাটি ব্যবহার করা হয় ।
কাঁচবালি
বাংলাদেশের সিলেট জেলার লালঘাট ,বালিয়াজুরী ও কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম এলাকায় বেলে পাথর ও কাঁচাবালি সঞ্চিত রয়েছে ।
ব্যবহার
বিভিন্ন ধরনের কাঁচ প্রস্তুতিতে রাসায়নিক ইট তৈরিতে কাঁচবালি বালি ব্যবহার করা হয়।
ধাতব খনিজ
১।লৌহ আকরিক
দিনাজপুরের হাকিমপুরে উপজেলার ইসবপুর গ্রামে আগ্নেয়শিলার স্তরে লৌহ আকরিক সঞ্চিত
রয়েছে। বিশেষ করে ফাটল বরাবর ভূগর্ভের ১৩০০ থেকে ১৬৫০ ফুট গভীরে লোহার
স্তরপাওয়া গেছে। খনিটির আয়তন প্রায় ১০ বর্গ কিলোমিটার ।খনিটিতে প্রায় ৫০০
থেকে ৬০০ মিলিয়ন টন লোহা সহ মূল্যবান পদার্থ রয়েছে। এটি বাংলাদেশের প্রথম
লোহার খনি ।এখানকার লোহার মান ৬০ শতাংশের উপরে।
২।গ্রানাইট
দিনাজপুর জেলার মধ্যপাড়ায় বাংলাদেশের একমাত্র গ্রানাইট পাথরের খনি অবস্থিত ।২০০৭ সাল থেকে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নামনাম ২০০৭ সালে খনিটি নির্মাণ শেষ করে এবং উৎপাদনে নিয়ে আসে। খনিটি ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ আবিষ্কার করে।
এখানে প্রায় ১ বর্গ কিলোমিটার
এলাকায় অতি স্বল্প গভীরতায় গ্রানাইট পাথরের মজুদ রয়েছে। মজুদের পরিমাণ ১৭ কোটি
৪০ লাখ টন যার প্রায় ৪২ শতাংশ উত্তোলনযোগ্য ।বছরে ১৬ লাখ টন করে উত্তোলনের
মাত্রা ধরে নির্মিত এই খনি থেকে ৭০বছর ধরে উত্তোলন করা যাবে।
অবকাঠামো উন্নয়ন কাজে যেমন -বৃহৎ সেতু সড়ক ও মহাসড়ক নদী শাসন নদী ভাঙ্গন রোধ ও
বন্যা নিয়ন্ত্রণে কঠিন শিলার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
শেষ কথা
উপরে আলোচনার প্রেক্ষিতে এ কথা বলা যায় যে ,খনিজ সম্পদ যেকোনো দেশের জন্য একটি
গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সম্পদ ।কোন দেশের উন্নয়ন এবং দ্রুত শিল্পায়নের
ক্ষেত্রে এর কোন বিকল্প নেই ।বাংলাদেশ খনিজ সম্পদ এ সমৃদ্ধ নয় তবুও যে
সীমিত সংখ্যক খনিজ সম্পদ পাওয়া গেছে সেগুলো আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে ।সরকার যদি পরিকল্পিত উপায় অনুসন্ধান ,উত্তোলন ও
ব্যবহার করে তবে তা বাংলাদেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url